প্রাকৃতিক গ্যাসসম্পদে ভরপুর দক্ষিণের দ্বীপ জেলা ভোলা। পত্রিকার পাতায় প্রায়ই খবর ছাপা হতে দেখি- ভোলায় টিউবওয়েলে গ্যাস বের হচ্ছে। ভূতাত্ত্বিক জরিপে ভোলায় প্রাকৃতিক গ্যাসের বিপুল মজুতের কথা কমবেশি সবাই অবগত। তবে সম্প্রতি পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা গেছে,

বাপেক্সের অনুসন্ধানী দল যে কয়টি নতুন গ্যাস কূপের দিশা পেয়েছে তার মধ্যে ‘ইলিশা-১’, ‘ভোলা নর্থ-২’ ও ‘টবগি-১৪’ নামের তিনটি কূপের খনন আগামী বছরের শুরুতেই শুরু করা হবে। এর আগে হদিস পাওয়া গ্যাস মজুতের স্থানগুলোসহ ভোলায় এ পর্যন্ত মোট ৯টি গ্যাসকূপের সন্ধান পেয়েছে ‘বাপেক্স’। ভোলার বোরহানউদ্দীনের শাহবাজপুর গ্যাসক্ষেত্রের চারটি কূপ ছাড়াও ‘শাহবাজপুর ইস্ট’ ও ‘ভোলা নর্থ’ নামে দুটি কূপে মোট গ্যাসের পরিমাণ ১.৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট বলে বিজ্ঞানীরা অনুমান করছেন।

এগুলোর মধ্যে কেবল ‘শাহবাজপুর ইস্ট’ গ্যাস কূপেই ৭০০ বিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুত আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আর ‘ভোলা নর্থ’ গ্যাসক্ষেত্রে রয়েছে আরও ১ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। ভোলায় গ্যাস তোলার কাজটি করবে রাশিয়ান গ্যাস কোম্পানি ‘গ্যাজপ্রম’। তিনটি কূপের খোঁড়ার কাজ প্রায় শেষ এবং এখন চলছে ছয়টি কূপের খোঁড়াখুঁড়ি। এত প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুতের কথা বিবেচনা করেই বিজ্ঞানীরা বলছেন, ‘গ্যাসে ভাসছে ভোলা।’

তবে এর পাশাপাশি যে কথাটি প্রসঙ্গত এসেই যায়, তা হলো- গ্যাসে না হয় ভাসছে ভোলা, তবে কঠিন কাজটি হলো সেই গ্যাস তোলা (বা উত্তোলন করা)। দ্বীপ জেলা ভোলা, তাই ভোলার গ্যাস পাশের কোনো জেলায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু যে সম্ভাবনাটি অবারিত ও অপার, তা হলো ভোলায় গ্যাসভিত্তিক শিল্প-কারখানা স্থাপনের সুযোগ ও এর যৌক্তিকতা।

গ্যাস অনেক থাকলে তরল ঘনীভবনের মাধ্যমে সিলিন্ডারজাত করার বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে সেটি পরের কথা। এখনকার বাস্তবতা হলো, কূপগুলোর খননকাজ সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে নেওয়া এবং গ্যাসপ্রাপ্তি সাপেক্ষে তা উত্তোলনের প্রযুক্তিগত কার্যকৌশল বাস্তবায়ন করা। একটি কূপ খনন খুব সহজ কাজ নয়। এর চেয়েও বেশি কঠিন কাজটি হলো ভূতলের সেই গ্যাস পাইপলাইন বসিয়ে উপরে উঠিয়ে নিয়ে আসা এবং সংগ্রহযোগ্য ডিপোতে ধারণ করা।

গ্যাস তোলার কাজেও একটা বড় ধরনের ‘সিস্টেম লসের’ ব্যাপার থাকে। এ অনিবার্য অপচয় প্রশমনের মধ্যে নিহিত রয়েছে প্রকৌশলী ও ভূতত্ত্ববিদদের পটুত্ব বা মুন্সিয়ানা। আশা করি, আমাদের দক্ষ বিজ্ঞানীরা তাদের কাজে যে ধারাবাহিক সফলতার পরিচয় দিয়ে চলেছেন, তাতে ভোলায়ও তারা সফল হবেন, ইনশাআল্লাহ্। ভোলা দ্বীপের ভূগঠন এবং শিলাসোপানের বিন্যাস দেখে বিজ্ঞানীরা সব সময়ই ধারণা করতেন এখানে গ্যাস থাকতে পারে।

তবে গ্যাসপ্রবণ এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সিলেট, ছাতক, তিতাস, রশিদপুর, কৈলাসটিলা, হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ, সেমুতাং, কুতুবদিয়া, বেগমগঞ্জ, ফেনী, কামতা, ফেঞ্চুগঞ্জ, জালালাবাদ, নরসিংদী, শাহবাজপুর, সালদানদী, সাঙ্গু, বিবিয়ানা, মৌলবীবাজার ইত্যাদি গ্যাসক্ষেত্র একই বরাবর (অ্যালাইনমেন্টে) হওয়ায় ভোলার গ্যাস সম্ভাবনার কথা আগে এতটা সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়নি।

কিন্তু ১৯৬০ সালে এ দেশে প্রথম গ্যাস উত্তোলন শুরু হওয়ার ৫০ বছরেরও বেশি সময় পর ভোলার বোরহানউদ্দীন উপজেলার শাহবাজপুরে ০.৫১৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট প্রাকৃতিক গ্যাসের বিশাল মজুত আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সব উৎসাহী দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ভোলার দিকে। তবে ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য থেকে ধারণা করা যায়-ভোলার দৌলতখান, তজুমদ্দিন, লালমোহন, চর মোহন, চর মোন্তাজ, চর নিজাম, চর কুকরি মুকরি, চর সাকুচিয়া- এসব এলাকায় জরিপ চালালে অনুরূপ প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ পাওয়া যেতেও পারে।

আশা ছাড়লে চলবে না। অনুসন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। ১৯৭৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিয়ন অয়েল কুতুবদিয়ায় এ ধরনের একটি কূপের সন্ধান পায়। ক্ষেত্রটি ছোট বা মজুতের অনুমান কম বলে হয়তো এটি পরিত্যাগ করা হয়েছে। তবে চালু গ্যাসক্ষেত্রগুলোর মজুত নিঃশেষ হওয়ার আগেই আমাদের উচিত নতুন নতুন সম্ভাবনা মৃত্তিকার গভীর তলদেশ থেকে বের করে আনার জন্য সম্ভব সব শক্তি ও প্রযুক্তি প্রয়োগ করা। ধারণা করা হচ্ছে, ভোলায় হদিস পাওয়া প্রাকৃতিক গ্যাস অতি উচ্চমানের হবে।

এ ধারণার ভিত্তি হলো দেশের মোট ২২টি গ্যাসক্ষেত্রের মধ্যে যে দুটি উপকূলের অদূরে, সেখানকার গ্যাসের বলতে গেলে পুরোটাই মিথেন ও সালফারযুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রের গ্যাসই শুকনো এবং উচ্চমান ও মাত্রার হাইড্রোকার্বনসমৃদ্ধ। দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোর গ্যাস ভূভাগের জৈব পদার্থ থেকে উৎপন্ন বিধায় এর দাহ্য ক্ষমতা বেশি এবং ক্ষতিকর উপাদানের মাত্রা কম। আশা করা যায়, ভোলার গ্যাস এই ইতিবাচক গুণাবলির বাইরে যাবে না। ভোলায় এখন গ্যাসভিত্তিক এবং গ্যাস-সমর্থিত ভারী ও মাঝারি শিল্পগুচ্ছ গড়ে তোলার পথ-নকশা দাঁড় করাতে হবে।

ডাকতে হবে চীন, জাপান, জার্মানিসহ বিনিয়োগকারী দেশগুলোকে। শিল্প জ্বালানির একটা বড় মরতবা হলো গ্যাস। ভোলায় সেই গ্যাসসম্পদ অনগ্রসর দ্বীপ জেলাটিকে শিল্পসম্ভারে মুখর করে তুলুক, এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা। প্রাকৃতিক গ্যাস মজুত থাকা আর সেই মজুতের সন্ধান পাওয়া এবং গ্যাস মাটির গভীর শিলান্যাস থেকে বের করে তুলে এনে ঘনীভূত করে সিলিন্ডারজাত করার মধ্যে বিস্তর ব্যবধান রয়েছে। এটা ‘জিওলজি’ ও ‘জিওফিজিক্যাল’ বিদ্যার গভীর বিশ্লেষণ, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ব্যাপার, যা নিয়ে দেশের বিজ্ঞানীরা দিবারাত্র পরিশ্রম করে চলেছেন।

আমরা সাধারণভাবে যা বুঝি তা হলো, এই জটিল কাজে দেশের বিজ্ঞানীদের যথেষ্ট দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা ইতোমধ্যেই সঞ্চিত হয়েছে। এখন প্রয়োজন দেশি-বিদেশি অভিজ্ঞতা ও প্রযুক্তির সমন্বয়। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত দেখা গিয়েছিল, দেশের আহরণযোগ্য মোট প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ হলো ১২.৪৩ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। ২০১১ সাল নাগাদ আশার নতুন খবরটি ছিল-

এ পরিমাণটি অনেক বেশি, ২৭.১২ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। অর্থাৎ গ্যাসের চাহিদা মোতাবেক এই পরিমাণ মজুত দিয়ে সামনের আরও ১০-১২ বছর চলা যাবে। কাজেই নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র খুঁজে বের করার কোনো বিকল্প নেই। নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পেলে এবং গ্যাস ঠিকমতো তোলা গেলে প্রাকৃতিক গ্যাসের ‘মজুতও’ গড়ে তোলার কথা ভাবা যাবে। তবে এ কাজে সময় লাগবে। আরেকটি সহজ বিকল্প হলো,

বিদ্যমান গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর বিস্তার এবং গ্যাস আহরণের ‘সিস্টেমিক লস্’ কমিয়ে আনার স্বার্থে যা কিছু প্রয়োজন তার পূর্ণ প্রয়োগ এবং সদ্ব্যবহার সুনিশ্চিত করা। এটাকেই বিজ্ঞানীরা বলেন ‘গ্যাস গ্রোথ’। গত ১৫ বছরে দেশে গ্যাসের চাহিদা যে পরিমাণে বেড়েছে (বা বলা চলে বেড়ে চলেছে), তাতে দেখা যাচ্ছে দেশে মজুত গ্যাস তোলা এবং নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধানে সাফল্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক।

কাজেই নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং মজুত চিহ্নিতকরণের (Reservoir Characteriæation) অগ্রগতি নগণ্য মাত্রার। প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ন্যূনতম ভারসাম্য আনতে হলেও গ্যাস অনুসন্ধানের প্রকরণ ও পদ্ধতির সনাতন ধারা থেকে বেরিয়ে এসে আরও কার্যকর, টেকসই ও আধুনিক পথ ধরতে হবে। এ ব্যাপারে কালক্ষেপণের যেমন সুযোগ নেই; প্রত্যাশার বাহারি ও বাকসর্বস্ব প্রচারণারও কোনো অবকাশ নেই।

(তথ্যসূত্র : Journal of Natural Gas Geoscience, Vol.4, Issue-6 December 2019)